ক্যালাইডোস্কোপ
- সৌমিত্র বৈশ্য
- - ফেব্রুয়ারী ১৪, ২০২১
।।১৯।।
পরীক্ষার দিনগুলি
বুদ্ধ তার হাতের লেখা নিয়ে বড়ই বিব্রত, স্কুল জীবনের একেবারে গোড়া থেকেই। সে লেখে মন্থর গতিতে। প্রতিটি অক্ষর স্পষ্ট,আলাদা, সযত্নে লিখিত এবং কলমটা তাই কাগজের উপর অনেকটা চাপ দিয়ে সে লেখে। শ্লেটে লেখা শেখার সময় চেপে লিখলে, একটা শব্দ হত। সেই শব্দের মোহে, তার চাপ দিয়ে লেখার অভ্যেস হয়ে গেল, যা সে নিবের কলম দিয়ে লেখার সময়ও ছাড়তে পারেনি। অল্পদিনের মধ্যেই তার কলমের নিব বেঁকে যেত; খাতার কাগজ ছিঁড়ে যেত। সেজন্য কম বকুনি খেতে হয়নি বাবার কাছে। বাবা নতুন নিব কিনে এনে লাগিয়ে দিতেন। ড্রপার দিয়ে কালি ভরে দিতেন। কালির গন্ধটা তার দিব্যি ভালো লাগত। কি ছিল সেই গন্ধে ? ক্লাসের কে যেন বলেছিল, খেতেও স্বাদু। ওর নাকি ঠোঁটে কালি লেগে গিয়েছিল এবং টের পায় অন্যরকম স্বাদ আছে কালিটায়। বুদ্ধ অবশ্য কোনোদিনই মুখে দিয়ে স্বাদ নেয়নি, কিন্তু কালির দোয়াত খুললে গন্ধটা পেত। সুলেখা নামের এই কালিটা একদিন হারিয়ে গেল। কেউ স্কুলে দোয়াত, ড্রপার নিয়ে যেত। বুদ্ধ তিনটে কলম নিয়ে যেত। যদি লিখতে গিয়ে নিব বেঁকে যায়, সেই ভয়ে। স্কুলের শ্রুতলিপির ক্লাসে সে কোনোদিনই পুরো লিখতে পারেনি। কলমের গোড়ায় শক্ত করে ধরে, চেপে লিখত বলে, সে উত্তর জানা সত্ত্বেও , সব প্রশ্নের উত্তর পরীক্ষার খাতায় লিখতে পারেনি। অংকটায় একটু সুবিধে হত। ম্যাট্রিকে ৮৫ নম্বরের উত্তর লিখে, ৮৫-ই পেয়েছিল। কিন্তু অন্যসব বিষয়ে ৭০-৭৫ এর বেশী নম্বরের উত্তর লিখতে পারত না। এতেই তার চলে যেত।
কলেজের প্রথম পরীক্ষায় বসেও সেই মন্থরতা থেকে মুক্তি পেলোনা। অন্যরা যখন খসখস করে লিখে একের পর অতিরিক্ত কাগজ নিচ্ছে, তখন সে খাতার মধ্যবর্তী অংশে। ফিজিক্স , কেমিস্ট্রি-র প্রশ্ন পেয়েই বুদ্ধ প্রথম বেছে নিত গাণিতিক প্রশ্নগুলো, যেগুলোর উত্তর লিখতে কম সময় লাগে। সমস্যা হল বায়োলজি নিয়ে। এর মধ্যে ছবি আঁকা তার পক্ষে অসম্ভব । বাংলা ও ইংরেজি মোটামুটি উৎরে গেল।
দিপু পার্টি করা, গল্প-উপন্যাস পড়া আর আড্ডায় এতটাই মজে গিয়েছিল, পরীক্ষার নির্ঘণ্ট পাবার পর দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত ফাঁকিবাজীর পথ বেছে নিল। এছাড়া উপায় ছিল না তার। বুক এম্পোরিয়াম থেকে কিনে নিল Answers to Question Bank সিরিজের বইগুলো। ক্লাসে যেটুকু পড়ানো হয়েছে, সেটুকু নোট বই থেকে গিলে নিল। শুধু ভয় ছিল, প্রশ্ন যদি কোশ্চেন ব্যাংক থেকে না আসে। হলে বসে বুক দুরুদুরু করছিল। এমন অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম। স্কুলে সব পরীক্ষা সে নির্ভয়ে দিয়েছে। মায়ের মুখটা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবা কত স্বপ্ন নিয়ে তাকে এই কলেজে ভর্তি করেছেন। ভয়ে ভয়ে প্রশ্নপত্র খোলে। পুরোটা পড়ার পর সামান্য স্বস্তি পেলো। একেবারে ল্যাজেগোবরে হতে হবে না। ধীরে সুস্থে কলম খুলে উত্তর লিখতে থাকে। কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর সে জানে। কিন্তু লিখতে গিয়ে টের পায়, মনে এসেও কলমে আসছে না। বিজ্ঞান যে মুখস্থ গিলে পরীক্ষায় লেখার বিষয় নয়, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে। নাহ, আর ফাঁকি দেবে না পড়ায়।
পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে লুকুদার দোকানের সামনে সারথির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। সারথির মুখ দেখে বোঝা গেল না , পরীক্ষা কেমন হয়েছে। শেষ ক'সপ্তাহ সে যতটা পড়েছে, সারথি তাও করেনি। বলল, ওই একরকম হয়েছে। চল, আজ রিক্সায় যাই। সারথির কাকুরা আসছেন আমেরিকা থেকে। সঙ্গে আসছে ওদের একমাত্র মেয়ে যে নাকি ওখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। দিপু ওর ছবি দেখেছে। বয়সে সারথির চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। সারথি এই মেয়েটির ছবি দেখিয়ে , ও যে কত গুণী, তা নিয়ে অনর্গল বলে যেত। নিজের দিদির সম্পর্কে গর্ব থাকাই তো স্বাভাবিক। বোঝা গেল, সারথি নিজের পরীক্ষার চেয়ে কাকু কাকিমার আগমন নিয়েই বেশি উত্তেজিত। কাকু চাকরি করেন বিশ্ব ব্যাঙ্কে।
ভাগ্যিস, পরীক্ষার পর কাকুরা এসেছিলেন। না হলে সারথির আর পরীক্ষা দেওয়া হত না। প্রায় দেড় মাস, যতদিন কাকুরা ছিলেন, সারথির টিকির নাগাল পায়নি দিপু। খুব অভিমান হয়েছিল দিপুর। সে এখন পার্টি অফিসেও যায় না। স্যারের ট্যুইশন থাকায় বদরপুরও যেতে পারছে না। মা-ই আসেন । বাবা বাইরে গেলে, মা একা। সেদ্ধ ভাত খেয়ে কাটিয়ে দেন। আর দিপু লেখাপড়া ছেড়ে, জড়িয়ে পড়েছে পার্টি, সাহিত্যের আড্ডায়। মনটা মেঘলা করে একা একা ঘোরে শহরের পথে। একদিন বিকেলে প্রেমতলায় দেখে, বুদ্ধ আর মিঠুন একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকল। ওরা দিপুকে খেয়াল করেনি।
সারথি তখন রিক্সা করে, ওর আমেরিকান বোন মিসমিকে নিয়ে যাচ্ছিল প্রেমতলা দিয়ে। রিক্সা থেকেই সারথি দেখতে পায় না যে দিপু প্রেমতলার একটি পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দিপুও ওদের দেখতে পায়নি।(ক্রমশ)