ক্যালাইডোস্কোপ
- সৌমিত্র বৈশ্য
- - ফেব্রুয়ারী ৭, ২০২১
।। ১৭ ।।
হয়ে ওঠার দিনগুলো
দিপু আচমকা টের পায়, দিনগুলো কেটে গেছে শুধু হাসি খেলায়। দুয়ারে কড়া নাড়ছে পরীক্ষা । বিভূতিভূষণ আর শীর্ষেন্দু, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর জীবনানন্দ, এমনকি মার্ক্স- এঙ্গেলসও পরীক্ষা পাশ করাতে পারবেন না। সেজন্য প্রয়োজন নিবিষ্ট মনোযোগ । মার্ক্সের ইস্তাহার , গল্প-উপন্যাসকে এবার তাকে স্থানান্তরিত করে, লাডলি মিত্র আর দাস এন্ড মুখার্জীকে আপন করে নিতে হবে। ক্যালকুলাসের প্রথম চ্যাপ্টারই তো রকেট-গতিতে মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। স্কুলে তো সে এত অমনোযোগী ছিল না। রোজের পড়া রোজ শেষ করত। কোনোদিনই স্যারের প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারেনি , এমন হয়নি। বইগুলো নিয়ে কলেজের খাতার সাথে মিলিয়ে দেখে , প্রায় তিন মাস পিছিয়ে পড়েছে সে, ক্লাসের থেকে। দাদুর বাড়ীতে তাকে আলাদা একটা ঘরই দেওয়া হয়েছে পড়ার জন্য। সেখানে সে কি পড়ে, কেউ দেখতে আসে না। স্কুলে পড়ার সময়ও সে গল্পের বই, শুকতারা পড়ত। কিন্তু পড়ার সময় নয়। রোববারে দুপুরেই পড়ার অনুমতি ছিল। কিন্তু এখন সে সব বালাই নেই। মায়ের কড়া নজরদারী নেই। মা তো বদরপুরে। এখানে সে মুক্ত বিহঙ্গ। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিত। বাইরে থেকে পড়ার আওয়াজ শোনা যায় না। কলেজের ছাত্ররা নাকি স্কুলের মত দুলে দুলে , জোরে জোরে পড়া মুখস্থ করে না। সবাই মনে মনে পড়ে। এরকমই সে শুনেছে। সেটাও একটা সুবিধে। কিন্তু এখন তো দেয়ালে পিঠ থেকে গেছে। সে মনে মনে একটা রুটিন বানিয়ে নেয়। দিনে বারো ঘণ্টা পড়তে হবে। প্রতিজ্ঞার মত করে নিজের কাছেই উচ্চারণ করে। কেমিস্ট্রির একটা নোট বই কেনে পরদিনই বুক এম্পোরিয়াম থেকে। জি ডি টুলি, পি এল সোনির লেখা। বইটা কিনেই কলেজে গিয়েছিল। সেদিন ছিল কেমিস্ট্রির ক্লাস। সে বসেছিল সামনের দিকে। নির্মল দত্ত স্যারের ক্লাস। উনি পড়াতে পড়াতে গ্যালারি বেয়ে উপরের দিকে ওঠেন, আবার নামেন। দিপুর সামনে টুলি-সোনির বই দেখে খুব করে বকে দিলেন। যেন সে একটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ করে ফেলেছে। সল্ট টেস্টের জন্য দত্ত স্যারের লেখা একটা নোট বই আছে। ওটা সবাই কিনতে হয়। খুব সহজ করে সল্ট টেস্টের পদ্ধতি গুলো লেখা। তবে বইটা দোকানে পাওয়া যায় না। স্যারের বাড়ীতে গিয়ে কিনতে হয়। বইটা কিনতে গিয়ে স্যারের বইয়ের তাকে , দিপু দেখতে পায়, টুলি সোনি-র সেই বইটা। তবে বইটা ওর কাজে লেগেছে। ওদের ক্লাসে সৌম্য কেমিস্ট্রিতে ভীষণ তুখোড়। আর সুজয় পাল হচ্ছে বায়োলজিতে সেরা। তবু একদিন কি একটা তুচ্ছে কারণে, জায়গীরদার স্যার ওকে ক্লাস থেকে বের করে দেন। মুখ লাল করে নিঃশব্দে সে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সৌম্যদর্শন, মিতবাক ছেলেটি, বিনা প্রতিবাদে ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সুজয়ের সেই অপমান, দিপুর খুব বুকে বিঁধেছিল। সুজয় এরপর আর কোনোদিনই জায়গীরদার স্যারের ক্লাস করেনি। যেন, সেটাই ওর নিরর্থক অপমানের প্রতিবাদ।
দিপুর মনে পড়ছে, প্রথম দিনের ফিজিক্স ক্লাসে শৈলেশ স্যার বলেছিলেন, দোকানে গেলে দেখবে, লেখা আছে, টুডে ক্যাশ টুমরো ক্রেডিট । পরদিন গিয়ে ঢুকবে, দেখবে সেই একই কথা, টুডে ক্যাশ টুমরো ক্রেডিট ; এন্ড দ্যাট টুমরো উইল নেভার কাম টু ইউ। আজকের পড়া আজই করে নেবে। জীবনেও কোনো কাজ কাল করব বলে ফেলে রাখবে না। সেদিন স্যার বড় সত্যি কথা বলেছিলেন, আজ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে। আর মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে মনে। মায়ের অনুশাসনে থাকতে থাকতে, তার নিজের মধ্যে কোনো অনুশাসনের নিজস্ব বোধ গড়ে ওঠেনি। প্রকৃতপক্ষে সে বোধহয় আদতেই ছন্নছাড়া। অথবা, কড়া শাসনের বন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সে এত লাগামছাড়া হয়ে গেছে। কৈশোরে না পাওয়া মুক্তিগুলি এখন সে, তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে চাইছে, নিয়মের নিগড় ভেঙে। রেল কলোনীর ছোট্ট গন্ডি, যেখানে সকলেই সকলকে চেনে, সেই গন্ডিমুক্ত হয়ে, এই শহরে, অজস্র অচেনা মানুষের ভীড়ে, নিজের স্বাধীন স্বতন্ত্র পরিচয় খুঁজে পেয়েছে, যেখানে কেউ তাকে চেনে না; বদরপুরে তার একটা পরিচয় ছিল, যে পরিচয়ের সাথে জুড়ে থাকত পিতৃনাম আর ভালো ছেলের তকমা। এমনকি সদ্য জাগা আরেকটা শরীরের মন, যে মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করত, সেই মনকেও দাবিয়ে রাখতে হত। মনকে উন্মুক্ত করে কারো সাথে , এই ইচ্ছা, এইসব চাহিদার কথা বলার মত কেউ ছিল না। ক্লাস নাইনে ওঠার পর বাবলুর সাথে ঘনিষ্ঠতা হল। ততদিনে বহুবার ট্রাউজার ভিজে গেছে মধ্যরাতে। দিপু ভাবত, এটা কোনো অসুখ। হয়তো এই অসুখেে একদিন সে মরে যেতে পারে। বাবলুই তাকে এই মৃত্যুভীতি থেকে বাঁচিয়ে দিল। গভীর রাত অবধি জেগে সে পড়াশোনা করে। সযত্নে এড়িয়ে চলে অন্যসব বইয়ের ইসারা।
পরদিন কলেজ যাবার সময়, টের পায় চোখ জ্বালা করছে। সারথিকে জিজ্ঞেস করে, তার পড়ার খবর। সারথি সেসব প্রশ্নকে পাত্তাই দিল না। বরং সে উত্তেজিত ভাবে জানায়, সে জীবনানন্দের কবিতায় সারারাত অবগাহন করে, নিজেকে খুব পবিত্র মনে হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষা ? তার সহজ উত্তর, তিরিশ তো পাব। কলেজ স্ট্যান্ডার্ড পেলেই হল। ফাইনালে পুষিয়ে নেবে।
সেদিন কলেজে শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর বাংলার ক্লাস ছিল। বাংলা-ইংরেজিকে যতই কম গুরুত্ব দিক না কেন, পাশ তো করতেই হবে । জে আর সি আর এস পি বি'র মধ্যে জনপ্রিয়তায় জে আর সি অনেক এগিয়ে। তবু সবাই জেনে গেছে, ইনি একজন বড় কবি। কাজেই সসম্ভ্রমে সবাই তাঁর জন্য অপেক্ষা করে। বুদ্ধ তাঁর কবিতার বই পড়ে মুগ্ধ। স্যারের একটা অভ্যেস সেদিন বুদ্ধর চোখে পড়ে। কপালের উপর নেমে আসা চুলকে, মাথা ডান দিকে এক অদ্ভুত কায়দায় ঝাঁকারে ডান দিকে নিয়ে যাওয়া। সাধারণত, সবাই হাত দিয়ে কপালে নেমে আসা চুল , হাত দিয়ে সরায়। বেশ কৌতুক অনুভব করে বুদ্ধ। রোল কল করেই জিজ্ঞেস করলেন, কী পড়া? কে যেন বলে উঠল, বাংলা। স্যার স্মিত হেসে বলেন, সে তো জানি। আমি জানতে চাইছি পাঠের নাম। আগের দিন কি পড়িয়েছিলাম ? এবার সমস্বরে সবাই বলে উঠল, ফুল্লরার বারোমাস্যা। আজ স্যারকে পড়ানোয় পেয়েছে। মঙ্গলকাব্য, বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য, সাধারণ এক রমণীর রোজকার জীবনের সুখ-দুঃখ গাথা, - গল্পের মত করে বলে গেলেন। বুদ্ধর মনে হচ্ছিল মঙ্গলকাব্য নিশ্চয় স্যারের খুবই প্রিয়। ক্লাস শেষে বুদ্ধ স্যরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর কিছু বুঝতে না দিয়ে,ঝপ করে পা ছুঁয়ে একটা প্রণাম করে তাঁকে। স্যার ওর মাথায় হাত ছোঁয়ালেন। কী নাম তোমার ? বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত। কোথায় থাক, বাবার নাম কী,-এইসব টুকিটাকি কথা বলতে বলতে এগোতে লাগলেন কমন রুমের দিকে। যে কথাটি বলার জন্য বুদ্ধ এসেছে, এবার সেটাই বলল, স্যার, আপনার ‘ সময় শরীর হৃদয়’ পড়েছি। খুব ভালো লেগেছে। ততক্ষণে কমন রুম এসে গেছে। স্যার বললেন, একদিন এসো আমার বাড়ীতে। সুভাষ নগরে।
এর মধ্যে কলেজের সোশ্যাল উইক এসে গেল। ‘ সময় শরীর হৃদয়’ বুদ্ধকে এতটাই আলোড়িত করেছিল যে, তাঁকে অনুকরণ করে একটা কবিতা লিখে ফেলে। সেটা আবার মিঠুনকে পড়িয়েছিল। মিঠুন কবিতাটা ছিনিয়ে নেয়। বলে পরে আবার পড়বে। সোশ্যাল উইকে একটা দেওয়াল পত্রিকা বের হয়। এর ‘কুন্দকলি’ নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে একটা কবিতাও লিখে দিয়েছিলেন। বুদ্ধ অবাক হয়ে দেখে তার সেই অক্ষম কবিতাটি ‘কুন্দকলি’-তে শোভা পাচ্ছে। এটা যে নির্ঘাত মিঠুনের কীর্তি, বুঝতে অসুবিধা হয়নি। মনে মনে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল বুদ্ধ। সোশ্যালের শেষদিন মিঠুন ওর রাগ ভাঙিয়ে কলেজে নিয়ে যায়। সে চলে আসবে ভাবছিল। গান-টান শেষ হল। শুভ বলে ওদের ক্লাসের একটা ছেলে গান গেয়েছিল। জে আর সি আবার ইনচার্জ সমস্ত অনুষ্ঠানের। মাইকে এসে ঘোষণা করলেন, এবার পুরষ্কার বিতরণ হবে। সে মিঠুনের সাথে গল্প করছিল। নাম ডাকা হচ্ছে, আর এক এক করে ছাত্রছাত্রীরা পুরস্কার নিয়ে যাচ্ছে। আচমকা শোনে, স্বরচিত কবিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছে বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত। বুদ্ধ নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। নিশ্চয় অন্য কোনো ছাত্র আছে একই নামে। এবার আবার স্যার নাম ডাকলেন, সঙ্গে ক্লাসটাও বলে দিলেন। ভীষণ সংকুচিত হয়ে সে মঞ্চে উঠে পুরস্কারটা নিয়ে স্যারকে প্রণাম করে মাথা নিচু করে নেমে আসে। স্বরচিত গল্পে প্রথম হয়েছে, দীপেন্দু বিশ্বাস। এই ছেলেটাও ওদের ক্লাসের। জে আর সি স্যার মন্তব্য করলেন, সাহিত্যের আগামিদিনের ভবিষ্যৎ তাহলে সায়েন্সের ছাত্রদেরই হাতে। দীপেন্দুর গল্পটাও বুদ্ধ পড়েছিল। ভালো লাগেনি তার। দীপেন্দু যেচে বুদ্ধর সাথে কথা বলতে এল। সেদিন বুদ্ধর মনে হয়েছিল, এই ছেলেটা সবজান্তা ধরণের। কিন্তু সেদিন , ওরা কেউ জানত না, এক অমোঘ নিয়তি অপেক্ষমাণ ওদের জন্য। ( ক্রমশ)