'আমরা সবাই রাজা, আমাদেরই রাজার রাজত্বে'
- বার্তালিপি ডেস্ক
- - জানুয়ারী ২৬, ২০২১
রাহুল রায়
আজ গণতন্ত্র দিবসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতি পরিচিত গান “আমরা সবাই রাজা, আমাদেরই রাজার রাজত্বে...” মনে পড়ে । গণতন্ত্রের শাসন পরিকাঠামোর এর থেকে সহজ বর্ণনা বোধহয় আর হতে পারে না । গণতন্ত্রের সকল ক্ষমতা নাগরিকদের কাঁধেই অর্পণ করা হয়েছে । তাঁরাই সেখানে রাজা আবার তাঁরাই সেখানে তাঁদের রাজা নিয়োগ করবেন , প্রয়োজনে বদল করবেন । নিযুক্ত রাজা জনপ্রতিনিধি হয়ে দেশ ও দশের হিতার্থে কাজ করে যাবেন । গণতন্ত্রে নাগরিক ও শাসকের সম্পর্কটা খুব সুন্দর । গণতন্ত্রের সকল ক্ষমতার অধিকারী নাগরিকরা নিজেদের প্রতিনিধি হিসাবে রাজা নিয়োগ করেন । অর্থাৎ এখানে সম্পর্কের বিন্যাসটা কোনোভাবেই শাসক ও শাসিতের নয়, রাজা বা প্রজার নয় । কিন্তু বিন্যাসটা নৈরাজ্যেরও নয়। এমন নয় যে সবাই নিজেকে রাজা মনে করে যথেচ্ছাচার করছেন। কারণ সবাই রাজা হওয়া সত্ত্বেও এক জনই রাজা: ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’ কিন্তু রাজার সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক এখানে শর্তসাপেক্ষ: ‘নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?’ ‘স্বত্ব’ কথাটির অর্থ অধিকার। কিছুটা সার্বভৌমত্বেরও আভাস দেয় কথাটি। এখানে স্বত্ব প্রায় শর্তই। কিন্তু আমাদের পরিচিত রাজা-প্রজার সম্পর্ক সচরাচর চুক্তি বা শর্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। রাজা প্রজাপালক, প্রায় পিতার মতো। চলতি কথায় আমরা যাকে বলি, ‘হুজুর মা-বাপ’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় যে দেশে ‘আমরা সবাই রাজা’ হতে পারি, সেখানে একসঙ্গে সকলের রাজা হওয়ার ও রাজ্যে নৈরাজ্য না-আনার জন্য দুটি শর্ত একসঙ্গে পূরণ হওয়া প্রয়োজন, ১) এক জন ‘রাজা’ থাকবেন, ২) কিন্তু তিনি রাজা হবেন শুধুমাত্র এই শর্তেই যে আমরাও সবাই রাজা হব। রাজা নিজেও এই নিয়ম লঙ্ঘন করতে পারেন না। ভারতের সংবিধান গৃহীত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মুল কথা কিন্তু এটাই ।
রাজা তাঁর রাজ্যের স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীন ভাবে থাকবে । সে তাঁর মতো করে স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে পারবে , স্বাধীন মতো কাজ করতে পারবে । কিন্তু রাজার সেই অধিকার যদি না থাকে তাহলে তাঁকে আর যাই বলা যায় রাজা বলা যায় না । একই ভাবে গণতন্ত্র যদি নাগরিকরা স্বাধীনতা না পান তাহলে সেই শাসন পরিকাঠামোকে গণতন্ত্র বলা যায় না । ভারতে আধিকারিক ভাবে গণতন্ত্র ১৯৫০ সনের ২৬ জানুয়ারি থেকে গৃহীত হয়েছে সংবিধানে। সেই সংবিধান দেশের নাগরিকদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে মুক্ত চিন্তা করার অধিকার দিয়েছে । কিন্তু এটা বললে ভুল হবে যে এই সংবিধানের ফলেই মানুষ মুক্ত বা বিরুদ্ধ চিন্তা করতে পারছে । অনেকেই বলে থাকেন এই সংবিধানের ফলেই মানুষের চিন্তা আবার অনেক সময় ‘দেশের শাসকদের’ বিরুদ্ধে , ‘দেশের স্বার্থে’ যেতে পারছে । আদতে সহস্রাধিক বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ভারতীয় সভ্যতার গভীরে মুক্ত চিন্তার বা গণতান্ত্রিক আদর্শের শেকড় ছড়ানো আছে । একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ১৩৭ কোটি মানুষের দেশ ভারতে ৮০ শতাংশ মানুষ সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী । এই ধর্মের ইতিহাস অতি প্রাচীন । পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম বলেই সে পরিচিত । সেই সনাতন ধর্মে কৃষ্ণ ভগবান জ্ঞানে পুজিত হোন । কৃষ্ণ কিন্তু তাঁর রাজ্যের রাজার (কংস) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন । কংস অন্য ধর্মে বিশ্বাসী বা নাস্তিক ছিলেন না, তিনিও সনাতন ধর্মেই বিশ্বাস করতেন । কিন্তু তিনি ক্ষমতার অহংকারে অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন । কৃষ্ণ সেই অত্যাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন । অন্যভাবে বললে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তিনি চিন্তা করতে পেরেছিলেন, প্রচলিত ব্যবস্থা পরিবর্তনে এগিয়ে এসেছিলেন । সেই রাজ্যের কেউ এই দুঃসাহস করতে পারেনি, কৃষ্ণ ব্যতিক্রমী হতে পেরেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থার পরিবর্তন পরিবর্তন সাধন করেও ছিলেন । তাহলে কৃষ্ণকে আমরা কি রাজদ্রোহী বা দেশদ্রোহী বলে ঘৃণা করব ? না, করব না্, এই বিশাল দেশের মানুষ কোনোকালেই তা করেনি বরং ভগবান বলে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে ।
বেদ পৃথিবীর প্রাচীনতম দর্শন গ্রন্থ বলে বিবেচিত হয় । সনাতন ধর্মে বেদের স্থান অত্যন্ত শ্রদ্ধার । কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে যে এই দেশে বেদ সেই প্রাচীন কালেও শেষ কথা ছিল না । বেদকে ভিত্তি করে নতুন নতুন চিন্তার উন্মেষ আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই । বেদকে স্বীকার করে একসময় এই দেশে পুর্ব মীমাংসা, উত্তর মীমাংসা, সাংখ্য, যোগ, ন্যায় ইত্যাদি দর্শন এসেছিল । আবার বেদের বিরোধীতা করে বৌদ্ধ, জৈন, চার্বাক দর্শন এসেছিল । বেদকে কেন্দ্র করে যে ছয়টি দর্শন এসেছিল তাঁর মধ্যেও পারস্পরিক বিরোধীতা আছে । সেই পারস্পরিক বিরোধী দর্শনগুলো সেই সময়ের শাসক ও নাগরিকদের কাছে যে শুধু স্বীকৃতি পেয়েছে তা নয় , সম্মানও পেয়েছে । একই কথা বলা যায় বেদ বিরোধী দর্শণগুলোর ক্ষেত্রেও । বুদ্ধদেব কোনোদিন ভগবান ও অলৌকিক শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেননি , কিন্তু তা বলে তাঁর সম্মান জনমানসে একবিন্দুও কমেনি । বরং তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই প্রচলিত সনাতন ধর্ম ব্যবস্থার মধ্যে তাঁর প্রভাবে বিরাট পরিবর্তন হয়ে যায় । কেউ কিন্তু বুদ্ধদেবকে অসম্মান করেনি , তাঁর প্রভাবকে অস্বীকার করেনি । সংকীর্ণতা বেড়াজালে আবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থায় সেই সময় পরিবর্তনের ধারক ও বাহক হয়ে এসেছিলেন শাক্যমুনি বলেই সেই সময়ের ইতিহাস আমাদের বলে । মনে রাখতে হবে সেই ইতিহাস কিন্তু সেই সময়ের শাসকদের পৃষ্টপোষকতায় তৈরি হয়েছিল । আদতে কি শাসক কি জনসাধারণ সবাই তাঁর চিন্তাকে মুক্ত হৃদয়ে গ্রহণ করেছিল । তাঁকে ধর্মদ্রোহী , রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা কোনওদিন দেওয়ার চিন্তা তাঁদের দুঃস্বপ্নেও আসেনি ।
এবার আসা যাক আধুনিক যুগে । সামাজিক কুসংস্কার, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে চৈতন্য মহাপ্রভূ , রাজা রামমোহন রায়ম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দ নিজের মতো করে দাঁড়িয়েছিলেন । সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন এঁদের সংগ্রাম করতে হয়েছে । কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ এঁদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে ঠিকই কিন্তু বৃহত্তর ভারতীয় সমাজ তাঁদের পাশেই ছিল । রামমোহন রায় সতী দাহ প্রথা উচ্ছেদে , বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ রোধ তথা স্ত্রী শিক্ষার প্রচারে এগিয়ে এসেছিলেন । বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী হয়েও ধর্মের নামে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন । এক জায়গায় বলেছেন, ‘যে ধর্ম বা যে ঈশ্বর বিধবার অশ্রুমোচন করতে না পারে না বা অনাথ শিশুর মুখে এক মুঠো অন্ন তুলে দিতে পারে না ,সে ধর্ম বা সে ঈশ্বর আমি বিশ্বাস করি না ’ । এই কথা বলার জন্য কি বিবেকানন্দকে ধর্ম বিরোধী বলা যায় ? যায় না , ভারতবাসী বলেও নি । চৈতন্য, রামমোহ্ন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দের ব্যতিক্রমী চিন্তাকে সাদরে হৃদয়ে গ্রহণ করে নিয়েছে । আজ তাঁরা চিরস্মরণীয়, সমাজের আদর্শ ।
আজ ২০২১ এর বুকে দাঁড়িয়ে আমরা কিন্তু একটু অন্য চিন্তাই দেশজুড়ে দেখতে পাচ্ছি । সেই চিন্তা মুক্ত চিন্তা, ব্যতিক্রমী চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ভালোবাসে । তাঁরা ধর্ম, দেশের নাম করে মানুষের মুক্ত চিন্তাকে দমিয়ে রাখতে চায় । একমুখী চিন্তাই তাঁদের পছন্দ । তাঁরা চায় দেশবাসী যেন একভাবেই চিন্তা করে , মুক্ত চিন্তা, ব্যতিক্রমী চিন্তাতে তাঁদের মারাত্মক আপত্তি । এখানে সমস্যাটা হল তাঁরা কথায় কথায় যে ধর্মের, যে দেশের কথা বলে সেই ধর্ম , দেশ, সংস্কৃতি কিন্তু যুগ যুগ ধরেই মুক্ত চিন্তার পালন করে আসছে । এই দেশ যেমন নিজের দেহের বিভিন্ন জায়গায় যুগ যুগ ধরে ভিন্নতা সযত্নে ধরে রেখেছে, ভিন্ন চিন্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে তেমনি বাইরে থেকে আসা চিন্তাকে সাদরে গ্রহণ পুষ্ট হয়েছে । কথিত যে খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যিশু খ্রিস্টের শিষ্য সেণ্ট থমাস ৫২ খ্রিস্টাব্দ ও ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদের সহকর্মী মালিক বিন দিনের সপ্তম শতাব্দীতে ভারতে এসেছিলেন । ভারতের শাসকরা প্রচলিত চিন্তার বাইরে তাদের ব্যতিক্রমী চিন্তাকে সাদরে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন । বাস্তবে ভারতের ইতিহাস সাক্ষী যে মুক্ত চিন্তা, বিরুদ্ধ চিন্তার ইতিহাসই তো ভারতের ইতিহাস । সংবিধান তাঁকে শুধু আধিকারিক স্বীকৃতি দিয়েছে । ফিরে যাই কবিগুরুর গানের ছত্রে । গণতন্ত্রে ‘আমরা সবাই রাজা’, ‘আমরা’ অর্থাৎ দেশের নাগরিকরাই সকল ক্ষমতার উৎস । সংবিধান তাঁদের সেই অধিকার দিয়েছে । দেশের নামে , সংস্কৃতির নামে , ধর্মের নামে যারা এই অধিকার খর্ব করতে চান তাঁরা যে শুধু সংবিধান বিরোধীতা করছেন তাই নয় , ধর্ম , সংস্কৃতি, দেশের ইতিহাসের অপমানও করছেন । গণতান্ত্রিক মুল্যবোধ ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । সুদুর অতীত থেকে ভারত সেই ধারাকে সগর্বে বহন করে আসছে এবং আগামী দিনেও করবে । আজ গণতান্ত্রিক দিবসে আমাদের সেই সনাতন আদর্শকেই নিজেদের জীবনে, চিন্তায়, মননে ধরে রাখার শপথ নিতে হবে ।