ক্যালাইডোস্কোপ
- সৌমিত্র বৈশ্য
- - জানুয়ারী ২৪, ২০২১
।।১৬।।
কবি-পাঠক সংবাদ
জল গড়িয়ে গেছে এরমধ্যে বহুদূর ; বরাক নদীটির বুকে এখন বালু চিকচিক করে। দিপু কলেজ যাবার সময় দেখে ; জাহাজ গুদামের পাশ দিয়ে দেখা যায়। সারথি আর সে এখন একসাথেই কলেজ যায়। এখন তো ওরা কমরেড। পঁচিশ পয়সার কুপন বেচে, গোটা ক্লাসকেই কমরেড বানিয়ে দিয়েছে দিপু আর সারথি। সারথির নতুনপট্টীর বাড়িটি দিপুর ভীষণ ভালো লাগে। পুরনো ধাঁচের কাঠের দোতলা বাড়ী। পিছনে বড় উঠোন। তার চার পাশ ঘিরে আসাম টাইপের একতলা ঘর। রান্না ঘর, ঠাকুর ঘর, স্টোর রুম। আর কিছু ঘর পুরনো ভাঙা আসবাবে বোঝাই করা। সেসসব ঘরের দরজা কাউ খোলে না। একটা ঘর আবার কাঁসা-পিতলের বাসনে ভর্তি। সেসবের আকারও বেশ বড়। একটা ডেগে অন্তত পঞ্চাশ জনের ভাত রান্না করা যাবে। সারথি বলেছিল, এগুলোর এন্টিক ভ্যালু আছে। এন্টিক শব্দটা এই প্রথম কারো মুখে শুনল, যার সংগ্রহে এন্টিক জিনিষ আছে। এত বিশাল বাড়ীতে লোক বলতে মাত্র পাঁচ জন। একটা ঘরে থাকে ওদের সর্বক্ষণের কাজের দিদি। বিধবা, নিঃসন্তান মহিলা। বাড়ির আয়তন আর বাসনপত্র দেখে বোঝা যায়, এই বাড়ীতে একদিন লোকে গমগম করত। সারথির পূর্ব পুরুষদের জমিদারী ছিল সিলেটে। তখনই পূর্ব পুরুষের কেউ বাড়িটি বানিয়েছিলেন। শিলং-এও ওদের একটা বাড়ী আছে। সেটা এখন খাসিদের দখলে। সারথি বলেছিল, ভাগ্যিস কেউ বুদ্ধি করে দেশভাগের আগে বাড়ীটা বানিয়েছিলেন, তাই এদেশ মাথা গোঁজার মত ঠাই মিলেছে। এখন অবশ্য ওর জ্ঞাতিরা সবাই বিদেশ। শুধু ওর বাবাই রয়ে গেলেন । একটা কোওপারেটিভে চাকরী করতেন। সেখানে তেমন কিছু কাজ ছিল না। রুগ্ন, দীর্ঘকায় পুরুষ। হাঁফানিতে ভুগতেন। তবু তিনি ধূমপান করতেন। তবে সেটা গড়গড়ায় , যার নিচের অংশটা পিতলের। এর নলটা বেশ লম্বা। তামাকের সুগন্ধে ঘর ভেসে যেত। সারথি একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, কি রে খাবি নাকি ?
তুই খেয়েছিস ?
দুপুরে মা ঘুমিয়ে থাকলে আমি মাঝে মাঝে টান দিই।
সেই সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল একদিন। সারথির মা বেড়াতে গেছেন। কলেজে কি একটা ছুটি। ঘরের দরজা বন্ধ করে, অনেক কসরত করে সারথি হুঁকো ধরাল। নল দিয়ে টানলে , একটা গুড়গুড় শব্দ করে। কিন্তু গন্ধটা অসম্ভব মন মাতানো এবং মিষ্টি। প্রথম টানেই দিপু কাশতে শুরু করে। সারথি বলে, ধীরে বন্ধু, ধীরে। সারথি দেখিয়ে দেয় কি করে টানতে হয়। তবে কলকে সাজানোটা ভীষণ ঝকমারি। সেদিন হুঁকো টানার পর, দিপুর মনে হচ্ছিল, তার আত্মা অবধি সুগন্ধে ভরে গেছে।
সেদিন কলেজে ক্লাস হল না পরপর তিন পিরিয়ড। ক্লাস না থাকলে এখন বেশ মজাই হয়। অনেক বন্ধু হয়েছে ক্লাসে। আর ততদিনে ওরা লুকুদার স্টলে ঢোকার হকদার হয়ে গেছে। তিন কাপ চা, পাঁচ কাপ করে খাওয়া যায়। অন্যদের বলতে শুনেছে, লুকুদা, তিনটায় পাঁচটা দাও। লুকুদাও দিয়ে দেয়। দেখতে দেখতে একটা সময়, লুকুদা বাকীতেও চা দিত। ক্লাস না থাকলে , লুকুদার স্টল গুলজার করে তোলা ছাড়া আর কাজ নেই। সেদিন সব শেষ পিরিয়ড ছিল বাংলা। বাংলার ক্লাসটা অনেকেই ফাঁকি দেয়। সারথি খাতা খুলে রুটিন দেখে নেয়, কার ক্লাস। কোনো স্যারের নাম লেখা নেই। বাংলা ছাড়া আর মাত্র দুটো ক্লাস; কেমিস্ট্রি আর ফিজিক্স। এ দুটো ক্লাস ছাড়া যাবে না। শেষ ক্লাসে থাকবে কি না, দোনামনা করতে করতে, বাংলা ক্লাসের স্যার এসে গেলেন। শ্যামবর্ণ, শার্ট প্যান্ট পরা, জে আর সি-র মত ধুতি পাঞ্জাবী পরা নয়। মাথা ভরা ঘন চুল। ক্লাসে ঢুকে সোজা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। রোল কল করলেন। এবার একটা বই খুলে পড়া শুরু করলেন। ফুল্ল্ররার বারমাস্যা। স্যারের কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর। পড়াচ্ছেন , না নিজেই নিজের জন্য পড়ছেন, বোঝা যাচ্ছে না। একেবারে পেছনের সারিতে একটু মৃদু গুঞ্জন যেন শুরু হল। স্যারের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। আপন খেয়ালে পড়ে যাচ্ছেন। এবার পড়া শেষ হতেই, জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগল কবিতাটা ? ক্লাসের সবচেয়ে ফিচেল কমলেশ, সটান দাঁড়িয়ে উঠে বলল, খুব ভালো লেগেছে স্যার। কিন্তু বুঝতে পারিনি। বলেই সে বসে পড়ে। স্যার মুচকি হেসে বোঝাতে শুরু করেন। বোঝানো বলতে, প্রতিটি পংক্তি পড়ছেন, আর বাংলা গদ্যে অর্থ বলে যাচ্ছেন। ‘ মাংস নাহি খায় লোকে করে নিরামিষ’,-- কেন নিরামিষ খায় এটা জানার ইচ্ছে ছিল বুদ্ধর। জিজ্ঞেস করবে কি ? বুদ্ধ আর মিঠুন মাঝের দিকের বেঞ্চে বসেছে। ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস আর করাই হল না। ততক্ষণে ক্লাস শেষের ঘণ্টা বেজে গেছে। স্যার নাম ডাকার খাতা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কে ইনি ? নিজের নামও বলেন নি। কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। স্যারের একটা অভ্যেস বুদ্ধর চোখে পড়ল। মাথা ঝাকিয়ে, কপালের উপর নেমে আসা চুলগুলোকে বিন্যস্ত করা। এরকম কাউকে করতে সে দেখেনি। বুদ্ধর কৌতূহল হচ্ছে স্যারের নামটা জানার। উৎসাহী কেউ এর মধ্যে নাম জেনে এসেছে। লুকুদাকে জিজ্ঞেস করতেই বলে দিল। শক্তিপদ ব্রহ্মচারী। দিপুও শুনেছে। সে তো রোমাঞ্চিত। ছাপার অক্ষরে যার কবিতা দেখে কলকাতার দেশ, অমৃততে, তিনি আজ তাদের পড়ালেন। বুদ্ধ কবিতা পড়তে ভালোবাসে বটে। তবে রবীন্দ্রনাথের। দিপু মাঝে মাঝে গল্প লেখার চেষ্টা করে। কিন্তু কবিতা পড়ে প্রচুর। আর সারথির পাল্লায় পড়ে, জীবনানন্দের কবিতাও পড়েছে। যদিও পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু কেন যেন বুঝে উঠতে পারে না। দিপু আর সারথি টিলা বেয়ে উঠতে লাগল। দিপু মিঠুনের সাথে গল্প করতে করতে সুভাষ নগরের দিকের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মিঠুন বলল, আমাদের বাড়ীতে শকিপদ ব্রহ্মচারীর কবিতার বই আছে। দিপু বলে , আমাকে দিবি? মিঠুন রাজি হয়ে যায়। সেদিন সারারাত বুদ্ধ ডুবে গেল ‘সময় শরীর হৃদয়’-এর ছত্রে ছত্রে।(ক্রমশ)