ক্যালাইডোস্কোপ
- সৌমিত্র বৈশ্য
- - জানুয়ারী ১৭, ২০২১
।। ১৪।।
শীতকাল
শীতটা এবার বেশ জাঁক করে আসর বসিয়েছে। কার্তিকের শেষেই, ভোরে,হালকা হিম-লাগা বাতাসে ভরে যেত ঘরটা। ঘুমের মধ্যেই টের পচ্ছি, শীতল হয়ে আসছে দেহ। ঘুমঘোরেই, চোখ না খুলে টেনে নেই, পাশে রাখা বেডকভার। তবু শীত-শীত ভাবটা , সর্বাঙ্গে, ভিজে কাপড়ের মত লেপ্টে থাকে। এর কারণটা হল, ফ্যানের হাওয়া। দাদার আবার ফ্যান না চালিয়ে ঘুম আসে না। অথচ সে কোনো চাদর-টাদর ছাড়াই দিব্যি ঘুমোচ্ছে। এসময় ফ্যান চালানো নিয়ে কোনো অনুযোগ করলে, সে ঠাট্টা করে বলে, তুই হচ্ছিস শীতলরক্তি প্রাণী। উল্টে আমাকে উপদেশ দেয়, বেশি করে কাঁচা পেঁয়াজ-রসুন খেতে। দাদা নিজে কিন্তু পেঁয়াজ- রসুন না খেয়েই, শেষ-কার্তিকের ভোরবেলাকার হিমলাগা বাতাসে, ফ্যান চলিয়ে ঘুমোতে পারে । এতটুকু অসুবিধে হয় না তার। এরই মধ্যে কখনো হয়তো আমাকে ভোরে বেডকভার জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখে, দাদার হয়তো মায়া হয় আমার জন্য। একদিন রাতে ফ্যান না চালিয়েই ঘুমোতে যায়। আমি জিজ্ঞেস করি, ফ্যান চালাবি না? সে বলে, না, এখন বেশ ঠাণ্ডা লাগে। আমি সব বুঝেও , না বোঝার ভান করি। মনে মনে বলি, বাঁচা গেল। দাদা কি আমার মনের কথা বুঝতে পারে ? সম্ভবত না। ভাগ্যিস আমরা অন্যের মনের কথা বুঝতে পারি না। না হলে মানুষের কোনও রকম গোপনতা থাকত না। মানুষ তো শুধু ইট-কাঠ, ঘর-বাড়ি, সমাজ-সংসার নিয়ে বাঁচে না, তার চেয়ে অনেক বেশি বাঁচে, মনের গহীনে। কত কীভাবে, কত রকম ছবি আঁকে , স্বপ্নের, কামনা-বাসনার, বেদনারও ; কই, সেসব তো শুনতে পাই না , দেখতে পাই না আমরা। পাই না বলেই মানুষের মনের মত রহস্যময় আমাজনের জঙ্গলও নয়। যদি কোনো বিজ্ঞানী এমন কোনো যন্তর বানিয়ে ফেলতেন, যা দিয়ে মানুষের মন পড়ে ফেলা যায়, মনের সদর দরজা, জানালা হাট করে খুলে ফেলে, বে-আব্রু করে ছবি তুলে ফেলা যেত, তাহলে কি হতো ?
শীত এলে আমার মায়ের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ফুল গাছ তো আছেই, তার সঙ্গে জুড়ে বসে রকমারি সবজি লাগানো, তাদের পরিচর্যা করা। পাশের পাড়ার গোয়ালা বাড়ি থেকে গোবর বয়ে আনা, তাও মাথায় ঘোমটা টেনে। মাকে মাথায় ঘোমটা না টেনে পাড়ায় কখনো বেরোতে দেখিনি। আসলে বাবা এই পাড়ায় কনিষ্ঠদের দলে পড়েন। তাই মায়ের এটাই সহজাত সংস্কার, যে বড়দের সামনে মাথায় ঘোমটা না থাকাটা অসমীচীন। মাটি খুঁড়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শিম গাছ, লাউ গাছ, মুলো গাছ প্রতি শীতে লাগাবেনই। বাবা অবশ্য বাঁশ কামলা ডেকে লাউ আর শিমের জন্য মাচা বানিয়ে দিতেন। বীজ ফুঁড়ে যখন শিম আর লাউয়ের চারা বেরোত, এক্কেবারে ছোটবেলায়, আমার বিস্ময়ের সীমা থাকত না। আমি বসে বসে দেখতাম, চারার মাথায় , মুকুটের মত ঝুলে আছে বীজটা। একদিন সকালে দেখতাম, টুপ করে খসে পড়েছে সেই বীজ, আর চারাটা, রোদে, দু’দিকে বাহুর মত করে , মেলে দিয়েছে তাঁর দুটি পাতা। চারাগুলো বাড়ে, সঙ্গে বাড়ে মায়ের আনন্দ। আমরাও সেই আনন্দে শরিক হতাম। এখনো তাই হয়। তবে আমরা বড় হয়ে গেছি বলেই হয়তো, মায়ের সরল আনন্দের ভাগ দূর থেকে উপভোগ করি। আগের মত, তেমন আপ্লুত হই না। তবে বাবার যেন এসবে কিছুই এসে যায় না। মা বাবাকে দেখার জন্য ডাকেনও না। কিন্তু, মায়ের এই ফুল গাছ লাগানো, শীতে সবজি বাগান করার পেছনে যে নীরব প্রশ্রয় রয়েছে, সেটা এখন বুঝি। আগে মনে হতো, বাবা যেন কী রকম মানুষ! একটু দেখে গেলে কী-ই বা হয়। গম্ভীর বাবাকে সেকথা বলার সাহস আজও জুগিয়ে উঠতে পারিনি , আমরা দু’ভাইয়ের কেউ। বাবা বাড়িতে থাকেনই বা কতক্ষণ। স্কুল করে, ছাত্র পড়িয়ে, কোন ছাত্রের কি অসুবিধে হচ্ছে খবর নিতে বাড়ি যেতে, বিশেষ করে কারো অসুখ করেছে শুনলে, বাবা খুঁজে খুঁজে , পায়ে হেঁটে তার বাড়ি গিয়ে হাজির হবেনই। তারপর আছে বাবার আড্ডা। যে দোকানে ওঁরা আড্ডা দিতেন, সেখানে বাবাদের বড়দেরও আড্ডা ছিল। ফলে ওঁদের আড্ডা বসত, সাড়ে সাতটা- আটটায়। সেই আড্ডা গড়িয়ে সাড়ে ন’টার দিকে গড়াতেই বাবা বাড়ি ফিরতেন। দশটার মধ্যে খেয়েই, রেডিওর বাংলা খবর শুনে ঘুমোতে যেতেন।
এবার সংক্রান্তির দু’চার দিন আগে ঝপ করে শীত কমে গেল। সরস্বতী পুজোর সময় যেরকম উষ্ণতা থাকে, ঠিক সেরকম। সোয়েটার পরে, দিনের বেলা রাস্তায় বেরোলে, গরম লাগে। সংক্রান্তির একদিন আগে আকাশ পুরো মুখ ভার করা মেঘে ঢেকে রইল। প্রতি বছরই বাবা এক বোঝা খড় আনান। সংক্রান্তির দিন, ভোরে উঠে গরম জলে চান করে, খড়ের গাদায় আগুন লাগানো হয়। আগুনের উত্তাপে আমরা হাত সেঁকতাম। শরীর থেকে শীতও পালিয়ে যেত। এবার বারান্দায় মিঠে রোদে বসে পিঠে খাবার পালা। আমাদের সবার জন্য একটা করে জলচৌকি আছে। এখনো সেই রেওয়াজ চলে আসছে। তবে এবার, ভোরে উঠে দেখা গেল, দু’হাত দূরে কিছু দেখাই যাচ্ছে না। এত ঘন-গভীর কুয়াশায় ঢেকে আছে চারদিক। ঝটপট চান সেরে খড়ের গাদায় আগুন দিয়ে, আগুন পোহানো হল। শীত তবু গেল না। মা পিঠে সাজানো প্লেট দিয়ে দিয়ে গেলেন। একটু পরেই বেরোতে হবে। দাদা, আমি, বাবা,-- সবাই বেরিয়ে যাব। মা শুধু একা থাকবেন ঘরে। হয়তো পাশের বাড়ির মাসির সঙ্গে মাঝে খানিকটা সময় গল্প করে আসবেন। আমারা যখন বাড়ি থাকি না, তখন মা’র একা লাগে কিনা, সেটা তো জানতে চাইনি কখনো। যেন এই ঘর পাহারা দেওয়া, সবার জন্য রান্না করা, কাপড় কাচা, ঘরদোর সাফসুতরো রাখাটাই মা’র কাজ। আর এই সব মিলিয়েই মা’র সংসার। এর মধ্যেই মা’র জীবনের পরিপূর্ণতা। এনিয়ে মা’র মনে কোনো ক্ষোভ নেই।
আমি সোজা হাঁটা দিলাম মিঠুনের বাড়ির উদ্দেশে। মিঠুনের বাবা এমারজেন্সির সময় জেল খেটেছেন। নকশাল পার্টি করার জন্য। ছোটবেলা থেকেই বাবার বইয়ের সংগ্রহ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনী পড়ে, মিঠুনের বাবার মত মানুষদের প্রতি একটা আকর্ষণ বোধ করতাম। পার্টি-টার্টি বুঝি না, কিন্তু একটা মানুষ নিজের আদর্শের জন্য জেলে গেছে, এটা আমাকে রোমাঞ্চিত করত। যাঁদের কথা বইয়ে পড়েছি, তাদের মতই একজন মানুষকে সামনা-সামনি দেখব, এটাই ছিল মিঠুনের সাথে আমার বন্ধুত্বের গূঢ় রহস্য। ওকে আমি প্রথম দেখি কলেজে। মিঠুনের মুখেই শুনেছি, নকশালরা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করে। আমার মনে পড়ে যায়, মাস্টারদার কথা। আমি শিহরিত হই। ঘোর লেগে যায়। মিঠুনের বাবা দীর্ঘকায় মানুষ। মুগুর ভাঁজা পেটানো শরীর। ধুতি, পাঞ্জাবি পরেন। কালো রঙ। চুল আঁচড়ান ব্যাকব্রাশ করে। মাথা ভর্তি ঘন চুল। মিঠুনের ঘরের দরজা ঠেলে ঢোকার সময়, বুকের ভিতরে একটা পুকুর ছিল, তার জলে ঢেউ খেলে গেল। আজ আমি সত্যিই কি মিঠুনের বাবার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি ? মন তবে এত উচাটন করছে কেন ? গল্পে মন বসছে না। থেকে থেকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছি। আমি শুধু মিঠুনের বাবার ঠোঁট নড়াই দেখে যাচ্ছি। তিনি কি বুঝতে পারছেন ? এতে তো তাঁকে অসম্মান করছি আমি। এই গ্লানিবোধ থেকে নিষ্কৃতি জুটল আমার। ফুল এক প্লেট ভর্তি পিঠে নিয়ে এল আমার জন্য। লহমায় হারানো সম্বিত ফিরে পেলাম আমি। আবার সেই পুকুরে ঢেউ উঠল। ফুল কি একটু সময়ের জন্য আমাদের সাথে বসতে পারে না ? ও এখনো বাংলাদেশি কায়দায় মাথার উপর দিয়ে ওড়নাটা গলায় পেঁচিয়ে রাখে। এখনো কথায় কথায় ইন্ডিয়া বলে। মনে মনে বললাম, ফুল, একটু বসে যাও ( ক্রমশ )