ক্যালাইডোস্কোপ
- সৌমিত্র বৈশ্য
- - জানুয়ারী ১০, ২০২১
।।১৩।।
ঘাটের কথা -১
আমরা যেখানে ছিলাম, সেটা ঢাকা থেকে খুব একটা দূর নয় ; আবার নেহাত কাছেও নয়। আমাদের ছিলাম না-গাঁয়ের , না- শহরের লোক। বাইরের লোকে বলত, গ্রাম, বকুল গ্রাম। আমরা বলতাম, বকুল নগর। তার প্রমাণও আছে। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। বকুল নগর প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়। আমি সেই স্কুলে পড়েছি। আকাশী রঙের সালোয়ার পরে যেতাম। মাথায় সাদা ওড়না ঢাকা থাকত। কেউ কেউ হিজাব পরে আসত। প্রাইমারি স্কুলে আমরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তাম। তারপর যেতে হতো হাইস্কুলে। ঢাকা থেকে দ্রুতযান বাসে মাত্র চার ঘণ্টা লাগে আমাদের বকুল নগর পৌঁছতে। বাস যেখান থামে, সেখান থেকে রিক্সায় বকুল নগর আসতে হয়। রিক্সার চালককে বললেই হয়, বড় বড় শিমূল গাছের রাস্তা ধরে যাবা। তারপর ডানে ঘুরলে, দেখবা একটা বড় দীঘি। তাতে শাপলা ফুটে আছে। মেয়েরা ঘাটে বসে বাসন মাজে, কাপড় ধোয়, দীঘির পাড়ে নরম ঘাসের উপর মেয়েরা কাপড় শুকোয়। রিক্সা চালক গাছ, দিঘি চিনে চিনে এগোয়। আর সওয়ারি তাকে বলে যায়, এবার বাঁয়ে যান মিয়াঁ , ওই মরা কাঁঠাল গাছের পাশ দিয়া। সামনেই একটা মাঠ আর দুই খান খালি বাড়ি। কেউ থাকে না । ওরা ইন্ডিয়া চইলা গেছে । সবাই অপেক্ষায় আছে, কবে ওরা ফিইর্যা আইব। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, ওরা ফেরে না। দ্যাশের টানে, মাটির টানে, দিঘির টানে, শিমূল গাছের মায়াময় ছায়ার টানে, শাপলা ফুলের টানে, অঘ্রানের ধানের টানে, কোনো টানেই আর ফেরে না ওরা। যেন শূন্যে মিলায়া গেছে। রিক্সা চালক নীরবে শুনে যায়, আর প্যাডেল মারে। একসময় সওয়ারির গন্তব্য এসে পড়ে। ভাড়া মিটিয়ে সে নেমে পড়ে।
আমাদের বকুল নগর এরকমই। মানুষ গুলো আধপাগলা কিসিমের। শুনেছি বাবার মুখে, একাত্তরের ঝড়ের পরে, এরকম হয়ে গেছে। এরা অর্ধেক পৃথিবীর, আর বাকি অর্ধেক খোয়াব-দুনিয়ার মেহমান হয়ে ঘোরে।প্রায় সব বাড়িতেই এরকম এক-দু’জন মানুষ আছে। আমাদের বকুল নগরের শেষ প্রান্তে, যেখানে একটি নদী, একটি ছোট টিলার পাশ ঘেঁষে বাঁক নিয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে, আর নদীর দু’পারে ধু ধু বালুচর , শীতকালে জেগে ওঠে, সেদিকে একটি নাবাল জমি থেকে অজস্র নরকঙ্কাল , চাষিদের কোদালের কোপে কোপে ভূমি-গহ্বর ছেড়ে মানব সমাজে ঢুকে পড়ে। তারপর আলুথালু মানুষ দল বেঁধে দেখে এদের। আর্তনাদ করে কাঁদে। পরিচয়হীন কংকালগুলো মানুষের স্বপ্নে হানা দিতে থাকে। তারপর সবাই ঠিক করে, এদের নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। সেদিন নদীতীরে জড়ো হয় সবাই। এক এক করে ভাসিয়ে দেওয়া হল কংকাল। কেউ মনে মনে বলছে তোমাদের যেন জান্নাত নসীব হয়, কেউ প্রার্থনা করে তোমাদের অক্ষয় স্বর্গলাভ হোক। জলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে তলিয়ে যায় সব নরকঙ্কাল। সেই রাতে অঝোরে বৃষ্টি হয়, বজ্রপাত হয়। বিশালাকার গাছগুলো যেন আছড়ে পড়তে চাইছে মাটিতে। কেঁপে কেঁপে উঠছে সমস্ত প্রকৃতি, এমন যেন ওরাও মানুষের ক্রন্দনে অংশভাক ।
এইসবই শুনেছি আমার বাবার মুখে। আমি তখন আসিইনি পৃথিবীতে। আমার জ্যাঠামশাই একাত্তরে হারিয়্বে যান চিরকালের মত। পড়াতেন ঢাকার এক কলেজে। জ্যাঠাইমা আজো অপেক্ষায় আছেন, একদিন ফিরে আসবেন জ্যাঠামশাই। এরকম হারিয়ে যাওয়া মানুষের ঠিকানা প্রায় সব বাড়িতেই আছে। বাইরে থেকে কেউ বকুল নগর এলে মনে করবে, , এখানে সব মানুষই যেন অর্ধেক জাগ্রত, অর্ধেক ঘুমন্ত। আর চোখে ঘুম-ঘুম স্বপ্ন নিয়ে দিন গুজরান করে। বকুল নগরের জীবনে একটা তরঙ্গ আছে, সেটা মন্থর, ছায়াচ্ছন্ন, আতুর-বেদনাময় ধূসর। বকুল নগরের মানুষ তাই, বাইরে কোথাও গেলে, কোনো কাজে গেলে, স্বস্তি এতটুকু পায় না। তারা কাজ সেরে ফিরে আসে সত্বর।
রোজ আমাকে ঘাটে যেতে হয়। সাঁতার কাটি, চান করি। কাপড় কাচি। আমার বয়সী যারা আসে, তাদের সাথে গল্প করি। সকাল থেকেই মেয়েদের আনাগোনা চলে এই ঘাটে। কলসি কাঁখে জল নিয়ে নিয়ে যায়। ঘাটে বসে, জলের কাছে আমরা মন খুলে দেই। জলও শোনে সেই কথা। ফিসফিস করে বলা গোপন কথাও শোনে। জল শুধু শুনেই যায়, আর লুকিয়ে রাখে তার মনের কালো অতলে। এক বছর পর যখন ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দেওয়া হল আমাকে, আমার তখন মনের কথা বলার একটাই উপায় ছিল। বাঁধানো একটা খাতা। বকুল নগরে তখন আমরা , আমাদের মায়ের চোখে, সোমত্থ মেয়ে। আমার মা আমাকে বলতেন, সিয়ান মেয়ে। সিয়ান মেয়ের সবাধানে থাকতে হয়। কেন বলতেন, সেটা বুঝার বয়সও আমার হয়ে গেছে। ঘাটের সিঁড়িতে বসে জলে পা দিয়ে লাথি মারলে জল ছলাৎ ছলাৎ করে উঠত আর আমাদের ফ্রক ভিজিয়ে দিত। মুখেও পড়ত জলের ছিটে। আমরা সই পাতিয়েছিলাম, এসব মায়েদের কাছ থেকে শেখা। আমাদের তুলনায় বয়সে একটু বড় ছেলেরা আমাদের দিকে তাকাত। কে কার দিকে তাকায়, কে কাকে বইয়ের ভিতরে করে চিঠি দিল, সব গল্প হত আমাদের ওই ঘাটে বসে। কার কোন ছেলেকে ভালো লাগে, কিছুই আমরা গোপন রাখতাম না। মঞ্জরী, শিউলি, টগর,-- আমরা তিনজন ছিলাম সই। একই স্কুলে, একই ক্লাসে পড়ি। এবার পাশ করে গেলে, অন্য স্কুলে যাব। ওখানে ছেলেদের বড় একটা স্কুল আছে। বকুল নগরের সবচেয়ে সুদর্শন ছেলে সামসুল সেই স্কুলে পড়ে। খুব ভালো ফুটবল খেলে, সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন। মা এখন আমাকে চোখে চোখে রাখেন। কেন রাখেন তার একটা বেদনাজনক কাহিনী আছে। আমার নিখোঁজ জ্যাঠামশাইর একমাত্র মেয়ে, পালিয়ে যায় শিমূলের সাথে। ওরা বিয়ে করে। কলমা পড়ে। শিমূলরা আমাদের তুলনায় বেশ অবস্থাপন্ন । বিয়ের পর শিমূলের বাবা এসেছিলেন আমাদের বাড়ীতে। বাবা যতটা ভদ্রভাবে সম্ভব , ভদ্রলোককে বিদেয় করে দেন। বলে দেন যে ওই মেয়ে আমাদের কাছে মৃত। চার বছর পর দিদির একটা ছেলে হয়। তখন সাহস করে ছেলেকে নিয়ে এসেছিল। রক্তের সম্পর্ক তো অস্বীকার করা যায় না। যতই সংস্কারে বাঁধা দিক, রক্ত তবু রক্তকে টানে। স্নেহের, মায়ার, বাৎসল্যের উষ্ণতায় গলে যায় সংস্কারের বরফ। কান্না হয়ে গলে পড়ল সেই বরফ। এর পড়ে শিমূলও এসেছিল। আমি দুলাভাই ডাকতাম। বাড়ির কাউকে না জানিয়ে, লুকিয়ে স্কুল ফেরত ঢুকে যেতাম দিদির বাড়ি। ওড়নাটাকে হিজাবের মত করে মুখ ঢেকে ঢুকে পড়তাম। ক্লাস এইটের পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট হই। সেই আনন্দে সেদিন ঢুকে পড়েছিলাম দিদির বাড়ি। কিন্তু কি করে যেন খবরটা বাবার কানে যায়। মাস খানেক আগে আমাদের বয়সী আরেকটি মেয়ে পালিয়ে জায়,রফিক বলে এক সাইকেল মেকারের সাথে ।
এক রাতে বাবা আমাকে ডাকলেন। বাড়ির সবাই ছিল। ঘরের পরিবেশ দেখে আমি ভয়ে কাঠ। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা বললেন, ফুল, তোরে সুশীলের ওখানে পাঠাইয়া দিমু। ওখানেই পড়বি। আমি চিঠি দিছিলাম সুশীলরে। ল্যাখছে কুনো অসুবিধা নাই। লহমায় আমার মন অন্ধকার হয়ে গেল। সেই ঘোর অন্ধকারে ডুবে আছে বকুল নগর, দীঘি, আমার সই, বড় বড় গাছের ছায়া। আমাকে ইন্ডিয়া চলে যেতে হবে! সেই রাতে খুব কাঁদলাম আমি। মা বললেন, আমরা তো যামু বছরে এক দুই বার। ওখানে গেলে দেখবি, ভাল্লাগবে। কান্দিছ না মা।
বাবা , মা আমাকে নিয়ে এক দুপুরে রওনা দিলেন ইন্ডিয়া। সইরাও কাঁদল। দিঘির জল কাঁদল। ছায়াময় পথ কাঁদল। আকাশ কাঁদল। মেঘেরা দল বেঁধে দেখতে এল আমার চলে যাওয়া। এক সন্ধে আমি মায়ের হাত ধরে নামলাম ট্রেন থেকে। বাবা রিক্সাচালককে বললেন, পাব্লিক স্কুল রোড চল। যেতে যেতে সব পথ গুলিয়ে গেল আমার। আর আমি মনে মনে তুলনা করছি, জায়গাটা আমাদের বাংলাদেশের কোন শহরের মত। এখানে তো সবাই বাংলাতেই কথা বলে। সেই রাতে ঘুমের মধ্যে দুলাভাইয়ের চাচাতো ভাই ফারুক দেখা দিল। বলল, ফুল , তুমি চলে গেলে ? (ক্রমশ)