ক্যালাইডোস্কোপ
- সৌমিত্র বৈশ্য
- - ডিসেম্বর ২৭, ২০২০
।।১২।।
বন্ধু-বৃত্তান্ত - এক
কলেজে ভর্তি হবার মাস দুয়েকের মধ্যে, যারা থোড়া বহুৎ আড্ডাবাজ, যারা শুধু ভালো ফল করতে চায় পরীক্ষায়, যাদের মাথায় ততোদিনে হরেক ভূত বাসা বেঁধেছে, যেমন কবিতা লেখার ভূত, লিটিল ম্যাগাজিন করার ভূত, সমাজ বিপ্লবের ভূত, প্রেমের ভূত, কারো একলা থাকার ভূত (যেমন সঞ্জীবের কোনো বন্ধু ছিল না এবং পরীক্ষায় অসাধারণ ভালো ফল করে, আই আই টি-তে পড়তে যায়। কিন্তু তার কোনো বন্ধু না থাকায়, সবার স্মৃতি থেকে সে হারিয়ে যায়। শুধু বুদ্ধ তার এক বন্ধু মারফত সঞ্জীবের খবর পেয়ে যেত। সঞ্জীব সংসার পাতে নি। সে নাকি লাখ টাকা বেতনের চাকরী ছেড়ে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী হয়ে যায়। শুনে, দিপু অবশ্য অবাক হয়নি। তার নাকি বরাবরই মনে হত, সঞ্জীবের মধ্যে একটা দার্শনিক প্রজ্ঞা ও দৈব প্রভা আছে ; না হলে, ঐ বয়সের একটা ছেলে এত গম্ভীর থাকতে পারত না), কারো বা নাটকের ভুত,-দেখা গেল, যাদের যেমন ভুতের ভর হয়েছে, তারা ছোট ছোট বৃত্তে জুড়ে গেল, যার নাম বন্ধুত্ব,নিজেদের মধ্যে নিরন্তর সঙ্গ লাভের অদম্য উন্মাদনা ; এমন যেন দেখা না হলে, দিনটি বিরস, বৃথা, অহেতুক প্রলম্বিত , একঘেয়ে, বিরক্তিকর। সেদিন একা পথে পথে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘোরা, যাকে কখনোই পছন্দ নয়, তার সাথে এক ঘণ্টা কথা বলে, নিজেকে উৎপীড়িত করা। আর যদি পরদিন দেখা হয়ে যায়, সকলের সাথে, বাকী পৃথিবীটা লহমায় মুছে যায়। কাউকে খুঁজে পেতে হলে, শহরের এপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হয় হেঁটে। শৈশব- কৈশোরের যে বন্ধুত্ব, তার মধ্যে থাকে শুধু বোধহীন আবিলতা। অপছন্দের, ভালো-না-লাগার কোনো অবকাশ তাতে নেই। শৈশবের অভ্যাসে গড়ে ওঠা,সেই বন্ধুত্বের ফিতেটা একটা বয়সের পর কী করে যেন, বিবর্ণ হয়ে যায়। তখন হঠাৎ দেখা হলে, কি, ভালো তো ? বা মাথা নেড়ে মুচকি হেসে চলে যাওয়া ছাড়া, আর কোনো আবেগ কাজ করে না। আর ভেবে অবাক হতে হয়, একদিন একে ছাড়া বিকেল কাটত না, স্কুল যাওয়া হত না, ডি এস এ মাঠে এন এম গুপ্ত ট্রফির খেলা দেখার কথা ভাবা যেত না ! তবে মনের অনেক গভীরে, যেন কুয়োর গভীরে টলমল করে কালো জল, তেমনি ভালোবাসার বোধ কাজ করে। এই যেমন নন্দুর পক্স হওয়ার খবর পেয়ে, বুদ্ধ ছুটে গেল। দিনরাত ওকে সঙ্গ দিত। পক্স হলে একা থাকতে হয়। তখন একেবারে একা থাকা, ভীষণ কষ্টকর। বন্ধুরা দূরে থাক, বাড়ির লোকজনও কাছে আসতে পারে না। দিনরাত মশারির ঘেরাটোপে শুয়ে-বসে আরোগ্যের প্রতীক্ষা করা, বড় বিরক্তিকর।নন্দুর সেই একঘেয়ে-বিরক্তিকর দিনগুলোতে, বুদ্ধ, প্রতিদিন ওকে সঙ্গ দিয়ে গেছে। অথচ নন্দু সেরে ওঠার পর বুদ্ধ যায়নি ওর বাড়ী আর ।
এরমধ্যে কলেজ মজলিস নির্বাচনে এসএফআই বিশাল জয় পেয়েছে। অরূপদা ভাইস প্রেসিডেন্ট,জসীমউদ্দীনদা জেনারেল সেক্রেটারী নির্বাচিত হয়েছে।নির্বাচনের ফল বেরোবার পর কলেজ চত্বর জুড়ে লাল আবিরে রঙিন হয়ে উঠল বাতাস।বেরোল বিজয় মিছিল। সেই মিছিল ঘুরল শহরের আনাচে কানাচে। দিপুও জীবনে প্রথম একটা মিছিলে, আর সবার সাথে , পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটল ; ছোটবেলা রেল কলোনিতে কত মিছিল দেখেছে এমন। দিপু অনুভব করে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ শ্লোগান দেওয়ার সময়,আমর্ম প্রত্যয় আর তীব্র আবেগ মিশে যায়। সারথি আর দিপু ওদের ক্লাসের সব ছাত্রকে পঁচিশ পয়সার মেম্বারশিপ কুপন বেচে দিয়েছিল। দিপু বা সারথির মত যারা কলেজ-নির্বাচনে এসএফআই-এর হয়ে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছে, অরূপদা একদিন তাদের সকলকে নিয়ে কমনরুমে বসল। এখন আর ওদের বয়েজ কমনরুম থেকে তাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা কারো নেই। দিপু তো অরূপদার সরল, অমায়িক আচরণে মুগ্ধ। মিটিং শেষে যেচে নিজে থেকেই আলাপ করতে গেল। সে বদরপুর রেল কলোনি থেকে এসেছে জেনে, ওর পরিচিত কয়েকজনের নাম বলল, যে এঁদের সে চেনে কি না। এঁদের তো সে জ্ঞান হওয়া ইস্তক চেনে। বাবার খুব কাছের মানুষ ওঁরা। বাবা ওঁদের দাদা ডাকেন ; মিত্রদা, গোস্বামীদা বলেই ডাকতে শুনেছে। বাবা নিজেও তো অবসরে পার্টি অফিসে গিয়ে পত্রিকা পড়েন, গল্প করেন। গণশক্তি পত্রিকার নাম দিপু জানত। সবটা শুনে অরূপদা বলে, তুমি তো দেখছি আমাদেরই ছেলে। ‘আমাদের ছেলে’ ,- কথাটা গেঁথে রইল দিপুর মনে। এরমধ্যে যেন ভেসে রইল আত্মীয়তার সুর। একদিন দিপু আর সারথি গেল নাজিরপট্টিতে সিপিএম-এর পার্টি অফিসে। অরূপদাই আসতে বলেছিল ওদের। দিপু অবাক হয়ে দেখছে অফিসটা। চারপাশে অনেক ছবি। কয়েকজনের ছবি দেখলেই বোঝা যায়, এরা বিদেশের। একজনের মাথা ভরা চুল, এক মুখ দাড়ি। কে ইনি? একজন বয়স্ক ভদ্রলোক একটা চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করছেন, নিবিষ্ট মনে। সারথি বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখিয়ে, ফিসফিস করে দিপুর কানের কাছে মুখ এনে বলে, জানিস, উনি ক্ষিয়ে,দিপু ওকে দেখল এই প্রথম। চিনবে কি করে। সে মাথা নাড়ে। সারথি বলে, ইনিই গোপেন রায়। পরে বলব তোকে। সারথির চোখে মুখে উপচে পড়া মুগ্ধতা ; দিপু বুঝতে পারে, এই বয়স্ক ভদ্রলোকের জীবন, আর পাঁচ জনের মত নয়।
আরো কিছু ছেলে বসে আছে পার্টি অফিসে। ওদের কাউকেই দিপু চেনে না। মেঝেতে চাটাই পাতা। অরূপদা এলো একটু পরেই। এসেই এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করল, কখন এসেছ?(ক্রমশ)