বাংলামিডিয়াম (১৩)
- অভিজিৎ চক্রবর্তী
- - নভেম্বর ১৫, ২০২০
বাঙালি কত কী খায়গো, কসম খায়, চশম খায়, বিষম খায়, ঘুষ খায়, গোল খায়, ঘোল খায়, গুলি খায়, গ্যাস খায়, বাঁশ খায়, শক খায়, পাক খায়, থ খায়, খাপ খায়, খাবি খায়, টাকা খায়, ধোকা খায়, ভয় খায়, লস খায়, লাট খায়, ল্যাদ খায়, ছ্যাঁকা খায়, টাল খায়, পোড় খায়, পাল্টি খায়, শুধু শুধু মাথা খায়, চোখের মাথা খায়। খায় আর খায়। সে খাক, কার তাতে কী, খেয়ে হজম করতে পারলেই হলো। তবে হ্যাঁ, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না, অবস্থাটা সেযুগেও সুবিধের ছিল না, এযুগেও সুবিধার নয়।
ভারি কথায় যাবার আগে একটা কিসসা শোনাই। একবিংশের প্রথম বছর। তিন বন্ধু মিলে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করি। বর্তমানের খ্যাতনামা সম্পাদক, সেদিনের সদ্য তরুণ বন্ধুটির সঙ্গে গুয়াহাটির চাঁদমারিস্থিত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্টাফ কোয়ার্টারে গেছি জনৈক প্রাবন্ধিকের একটি প্রবন্ধের সন্ধানে। তিনি আমাদের বিষয় অনুযায়ী অসমিয়ায় লিখে দেবেন, আমরা বাংলায় অনুবাদ করে নেব। প্রাবন্ধিক বাড়িতে নেই। তাঁর স্নেহময়ী স্ত্রীর সঙ্গে কিছু সৌজন্যবার্তা বিনিময়ের পর আমরা ফেরার পথে পা বাড়িয়েছি। তিনি বারান্দা পর্যন্ত এসেছেন বিদায় জানাতে। পুরনো আসাম টাইপ ঘর। রাস্তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিত উঁচু করতে করতে বারান্দার উচ্চতা বেশ খানিকটা কমে গেছে। আমরা বারান্দা ছাড়ার মুখে মধুকণ্ঠী বললেন-- "এইখিনি বড় চাপর, চাই লোয়া, খুন্দা খাবা দেই।" "নাখাও বাইদেউ, আপনি চিন্তা নকরিব।"-- বন্ধুটি জানায়। বন্ধুটি আমার ভূমিপুত্র, অসমিয়ায় মাতৃভাষার মতো সাবলীল। আমি বহিরাগত, ৯৮ সালের শেষ লগ্নে অসমে এসেছি। আন্দাজে অসমিয়া বুঝতে চেষ্টা করি, তৎসম ঘেঁষা দুয়েক শব্দে উত্তর দিই। ততক্ষণে আমি মহিলার বক্তব্য আন্দাজে অনুবাদ করে নিয়েছি। "এইখিনি বড় চাপর, চাই লোয়া, খুন্দা খাবা দেই।" মানে এখানে বড়ো ভালো চা পাওয়া যায়, চা দিই, খুন্দা খেলে দিতে পারি।" তখন আমাদের প্যান্টের নিচে পাজামা। পাজামার পকেটে টুথব্রাশ। প্যান্টের পকেটে যা থাকে তাতে সিটি বাস এড়িয়ে হাঁটতে হয় মাঝেমধ্যেই। সকালে উঠে বেরিয়ে পড়ি। এর ওর বাড়ি সাহিত্য আলোচনার ছলে নাস্তা করি। সেইদিনটা ভালো ছিল না। ঘড়িতে দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু পেটের তখনও সকাল কাটেনি। এই অবস্থায় বন্ধুটি কিনা অফারটা হাতছাড়া করল! বললাম-- "ভদ্রমহিলা খেতে বললেন, তুই না করলি কেন?" বলল-- "তুই কখনো খুন্দা খাসনি না? যেদিন খাবি সেদিন বুঝবি।" বুঝেছি। নানা জায়গায় নানা রকমভাবে খুন্দা খেয়ে বুঝেছি, বাঙালির মতো অসমিয়ারাও এমন অনেক জিনিস খান, যা একেবারেই খেতে ভালো না। উপরন্তু ফুলে যায়, টনটন করে।
খাওয়া বিষয়টা বাংলা মিডিয়ামে শুধু খাওয়া নয়, বাঙালির যাপনের প্রায় প্রতিটি অনুষঙ্গ খাওয়ার সঙ্গে জড়িত। খুব সহজ অর্থে বাঙালির অভিব্যক্তি-- জল ভাত। আর "দাঁত ফোটানো মুশকিল"-এর অর্থ চূড়ান্ত কঠিন। দাঁত ভাঙাও হতে পারে। বাংলা মিডিয়ামে দাঁত আর জিভ যেন সর্বত্র অবাধ প্রবেশের গেট পাস নিয়ে রেখেছে। সফলতার জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে বলে আর ব্যর্থ হলে বলে পরাজয়ের স্বাদ নিতে। ব্যবসায়িকে চুষে খেতে বলে, লাভকে গুড়ের সাথে মিলিয়ে ভাবতে ভালোবাসে। উৎকট দুর্গন্ধের আলঙ্কারিক প্রকাশ হলো "অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসা", আর তরিবত করে পেট ঠেসে খাওয়া হলো ফাঁসির খাওয়া। এদের দরদ উথলে ওঠে, অপমান হজম হয় না আর রাগ উগড়ে দেয়। ধনবান হলে সোনার থালে ভাত খায়, নির্ধনের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এরা গোপন খবর রাখে হাঁড়ির ভেতর আবার সে খবর ফাঁস করার আগে হাঁড়ি হাটে নিয়ে ভাঙে। জন্মালে মিষ্টি খায়, বিয়েতে ভোজ খায়, মরলে শ্রাদ্ধ খায়। এমনিতে বিপদ কাঁটার মতো গলায় বিঁধে থাকে, বিপদ যত বাড়ে তত গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। এরা বড় করে পাত পাড়ে, নুন খেলে মনে রাখে, আঙুল চাটা আর চোষাকে যোজন দূরে বসিয়ে রাখে। কখনও গাছে না উঠতেই এককাঁদি পায় আবার আঙুর ফল টক বলে কখনো হতাশ হয়ে আঁটি চোষে। আরো আছে, অজস্র আছে, অযুত আছে। রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি ধর্ম বিজ্ঞান যেখানে যা কিছু আছে তার সমস্তটাকে বাংলামিডিয়াম মুখবিবর থেকে পায়ুদ্বারের মধ্যবর্তী জৈবক্রিয়ায় জারিত করে প্রকাশ করতে পারলে বর্তে যায়। কিন্তু কেন?
কে জানে, আমি সুকুমারমতি, শুধু জানি তিনি খাই খাই নামে একখানা বাংলা বাইবেল লিখেছিলেন, এবং যথার্থ লিখেছিলেন।
শুধু শুধু কথার খই ফুটিয়ে লাভ নেই, তাতে চিড়ে ভিজবে না, তার জন্য হাতে গরম প্রমাণ চাই। সে কাজ আমার সীমার বাইরে। তাছাড়া এ নিবন্ধ কোনো অ্যাকাডেমিক জার্নাল অভিমুখী নয়, সুতরাং নেপোয় দই মারলে মারুক। এবারে নটে শাকটি মুড়নোর সময় হলো। আজ দীপাবলি, আলোয় থাকবেন। একটা কিসসা দিয়ে আরম্ভ করেছিলাম, আর একখানা দিয়ে শেষ করা যাক।
বাবা মা বাংলায় ছটাক মিডিয়াম, ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামে আশি। দূর শহরে প্রতিষ্ঠিত। দীপাবলি উপলক্ষে গিফ্ট পাঠিয়েছে বাড়িতে। (কেমন যেন মনে হচ্ছে, দুধে ভাতে থাকার ব্যাকুলতায় আদা জল খেয়ে পড়তে পড়তে বেচারা প্রেমের মধু চাখতে পারেনি। নইলে…) দীপাবলির রাতে বাবা ছেলেকে চিঠি লিখছেন -- তোমার পাঠানো জিনিসগুলি পাইয়াছি। গোল গোল রসে ডোবা মিষ্টিগুলান বড় স্বাদ আছিল। তবে লম্বা সাদা খাড়া খাড়া হেগুর ভিতর সুতা ভরা, সেইসকল মিষ্টি আর পাঠাইও না। মিষ্টতা কিছু কম আছিল। -- আজ্ঞে, ঠিকই ধরেছেন, প্রথমটা রসগোল্লা ছিল আর দ্বিতীয়টা মোমবাতি।
পুনশ্চ: কালীপূজার খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে দুকথা লেখার ইচ্ছা ছিল, ঝুঁকি নিলাম না। (ক্রমশ)
(লেখক টংলা কলেজের বাংলার অধ্যাপক)